ইমাম আজম আবু হানীফা (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত:


●ভূমিকা:
ইত্তিবা (অনুসরন) আর তাকলীদ সমার্থক শব্দ। এ সম্পর্কে আমি আল কালামুল মুফীদ গ্রন্থের প্রামানিক আলোচনা পেশ করছি। আমরা ও আমাদের আকাবির এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন যে, কুরআনে কারীম, হাদীস শরীফ, খুলাফায়ে রাশেদুন এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম থেকে যেসব মাসায়েলে সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত বর্ণিত হয়নি, সেগুলোতে আমাদেরকে মুজতাহিদ ইমামের অনুকরন ও তাকলীদ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর তাকলীদকে অন্যান্য ইমামগনের তাকলদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা রাসূল (স.) এর ন্যায় আবু হানীফা (রহ.) কিংবা অন্য কোনো ইমামকে মাসুম বা নিষ্পাপ মনে করি না। তাদেরকে শুধু মাত্র মুজতাহিদ মনে করি। আর মুজতাহিদদের সম্পর্কে উসূলে ফিকহের নীতি হল, মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত যেমন সঠিক হতে পারে তেমনি ভুলও হতে পারে।
●ইমাম আযমের জীবনী:
তাঁর নাম নূমান বিন সাবিত ইবনে যূতা। তাঁর দাদা ছিলেন কাবূলের অধিবাসী। সে যুগে কাবূল ও আফগানিস্তান ছিল ইরানের অন্তর্ভক্ত। তাঁর পিতা সাবিত শৈশবে ইসলাম গ্রহন করার পর হযরত আলী (রহ.) এর দরবারে হাজির হন। তিনি হযরত সাবিত (রহ.) ও তাঁর ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য বরকতের দোয়া করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) 80 হিজরী সনে কূফা নগরীতে জন্ম গ্রহন করেন। -(মিফতাহুস সা’আদা, খ. 2, পৃ, 64)
যারা মনে করেন, হানীফা তাঁর মেয়ের নাম এবং এ নামেই তাঁর পিতার ডাক নাম হানীফা, তাদের এ ধারনা ভ্রান্ত ও মূর্খতাসুলভ। কেননা তাঁর কোনো মেয়ে সন্তানই ছিল না। 150 হিজরী সনে সত্তর বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন এবং আল খিজরান নামক কবরস্থানে সমাহিত হন। বাগদাদে তাঁর কবর অত্যান্ত পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। -(ইকমাল, পৃ, 624)
আবু হানীফা (রহ.) হযরত হাম্মাদ বিন আবি সুলাইমান, আতা ইবনে আবি রাবাহ, আবূ ইসহাক আস সুবাইয়ী, মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির, নাফে’, হিশাম ইবনে উরওয়াহ, সাম্মাক ইবনে হারব (রহ.) প্রমূখের নিকটি ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। তাঁর শীষ্যদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররা, ইয়াযীদ ইবনে হারূন, কাজী আবু ইয়ূসুফ এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শায়বানী (রহ.) প্রমূখ অধীক খ্যাত ও প্রসিদ্ধ। -(ইকমাল)
●ইমাম আযম রহ. তাবেয়ী ছিলেন:
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে নাদীম [মৃত্যু 385 হিজরী] বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. তাবেঈ ছিলেন। তিনি অনেক সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ‍তিনি ছিলেন পরহেজগার ও দুনিয়া বিমুখ। –[আল ফিহরিস্ত, ‍পৃ, 298]
হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা সাহাবায়ে কেরামের যুগ পেয়েছেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. এর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন। কোনো কোনো হাদিস বিসারদের মতে, তিনি সাতজন সাহাবী থেকে হাদিস রেওয়ায়েত করেছেন। –[বিদায়া নিহায়া, খ, 10, পৃ, 107]
ইমাম ইবনে আব্দিল বার মালিকী রহ. [মৃত্যু 463হি.] বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে জায রা. কে দেখেছেন এবং তাদের মুখ থকে হাদিসও শুনেছেন। –[জামিউ বায়ানিল ইলম, খ. 1, পৃ. 45]
আল্লামা জাহাবী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. 80 হিজরী সনে খলীফা মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে জন্ম গ্রহন করেন। তখন একদল সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। এ কথা অকাট্য প্রমানিত যে, ‍তিনি হযরত আনাস বিন মালিক রা. কে দেখেছেন। তাই আল্লাহর ফজলে তিনি তাবেয়ী। –[মানাকিবুল ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহিবিহী]
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, আল্লামা ইবনে সা’দ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, আবু হানীফা রহ. আনাস রা. কে দেখেছেন। এ হিসেবে তিনি তাবেঈর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর সমসাময়িক ইমামগন এই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। –[মুকাদ্দামাতু তুহফাতিল আহওয়াযী, পৃ.83]
সারকথা, ইমাম আবু হানীফা রহ. তাবেই ছিলেন। অস্বীকার করার জোঁ নেই।
●ইলমে ফিকহে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মর্যাদা:
ইমাম শাফেঈ রহ. বলেন, ”ফিকাহ শাস্ত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানীফা রহ. এর শিষ্য”-[তাযকিরাতুল হুফ্ফাজ, খ. 1, পৃ. 160] তিনি আরো বলেন, আমি ইমাম মালেক রহ. কে জিজ্ঞাস করলাম, আপনি কি আবু হানীফা রহ. কে দেখেছেন? তিনি উত্তরে বল্লেন হ্যা, দেখছি। তিনি এমন ব্যক্তি যদি এই স্তম্বটিকে দলিল প্রমান দিয়ে স্বর্ণ ‍প্রমান করাত চান তবে তিনি সফল হবেন। –[ইকমাল, পৃ. 625]
মিশকাত শরীফের রচয়িতা বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. ছিলেন আলেমে বাআমল, পরহেজগার, দুনিয়াবিমুখ, ইবাদাত গুজার ও উলূমে শরীয়তের ইমাম। মিশকাত শরীফে যদিও আমি তাঁর রেওয়ায়াতে কোনো হাদিস উল্লেখ করিনি, তবুও তাঁর আলোচনা করেছি শুধুমাত্র বরকত লাভের উদ্দেশ্য। কেননা তাঁর মর্যাদা অনেক উঁচু এবং তাঁর জ্ঞানের পরিধি সুপ্রশস্ত। –[ইকমাল, পৃ. 625]
●হিম্মত ও অবিচলতা:
বনু উমাইয়ার সর্বশেষ বাদশা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মাদ আল ‍হিমার –[মৃত্যু  132 হিজরী] এর শাসন যুগে ইরাকের অত্যাচারী ও অহংকারী গভর্নর ইয়াযীদ ইবনে আমর ইবনে হুবাইরা রাজনৈতিকভাবে তার অবস্থান ও ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার জন্য ইমাম সাহেবের কাছে বিচারকের পদ অলংকৃত করার আবেদন জানালেন। কিন্ত তিনি এ পদ গ্রহন করতে অস্বীকার করেন। এ অপরাধে তাঁর উপর একশ দশ বেত্রাঘাতের দন্ড জারি করেন। প্রতিদিন দশ বেত মারা হত। –[তারিখে বাগদাদ, খ.13, পৃ. 326]
তিনি ইমাম আবু হানীফাকে কিছুদিন কারাগারে আবদ্ধ করে রাখেন এবং প্রধান বিচারকের পদ গ্রহনের আবেদন জানান। কিন্ত তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। –[মানাকিবে সদরূল আয়িম্মাহ, 2/1173]
তিনি এ কথাও বললেন যে, সমগ্র ইসলামি রাস্ট্রে আপনার নির্দেশেই কাজী নিযুক্ত হবে। –[প্রাগুক্ত, 2/172]
আর এ প্রস্তাবও পেশ করলেন যে, বায়তুল মালের ব্যবস্থাপনা আপনার হাতেই সোপর্দ হবে এবং আপনার স্বাক্ষরেই বায়তুল মাল থেকে মাল বের হবে। – ‍[মুজাম, 2/177]
ইমাম সাহেবকে এই ইচ্ছাধিকার দেওয়া হল যে, হয়তো  আপনি এই পদ গ্রহন করুন, অন্যথায় আপনার কোমর ও পেটে টাবুক বর্ষিত হবে। তখন তিনি পরকালের শাস্তির উপর তাদের শাস্তিকেই প্রাধান্য দিলেন। -[মানাকিবে মায়াফফাক, 2/177]
ইমাম সাহেবের আম্মাজানও পরিস্থিতির ভয়াবহতার ভিত্তিতে বাধ্য হয়ে পদ গ্রহন করার পরামর্শ দেন। উত্তরে তিনি বলেন, আম্মাজান যে কথা আমি জানি, আপনি তা জানেন না। -[মানাকিবে মুয়াফফাক, 2/22, মানাকিবে কারদারী, 2/26]
অতঃপর কাজী ইবনে আবী লায়লা, ইবনে শুবরুমা ও দাউদ ইবনে আবি হিন্দ (রহ.) প্রমুখ ইমাম আবু হানীফার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারা সকলে প্রসাশনের দৃঢ় সংকল্পের কথা তাকে অবহিত করেলেন এবং পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা জানিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এক বাক্যে বললেন, আমরা আপনাকে আল্লাহ তা’য়ালার দোহাই দিয়ে বলছি, আপনি নিজের জানকে ধ্বংসর মখে ঠেলে দিবেন না। আমরা আপনার ভাই ও একই মত পোষনকারী। আমাদের কেউ এ দায়িত্ব পছন্দ করে না। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ নিরুপায়। আমাদের করার কিছুই নেই। ইমাম সাহেব (রহ.) বলেলন, ইবনে হুবাইরা যদি আমাকে ওয়াসেতের মসজিদের দেয়ালগুলো গুনার ‍নির্দেশ দেয়, তাও আমি পালন করতে প্রস্তুত নই। -[মানাকিবে মুয়াফফাক, 2/24, কারদারী, 2/27, আল খায়রাত, পৃ. 58]
কেমন হিম্মত ও সাহস ছিল তাঁর! জালিমের সাথে সম্পুর্ণরূপে বয়কট করে, কোনো ক্ষেত্রে তার অংশীদার হতে প্রস্তুত হননি। সব ধরনের অন্যায় ও অত্যাচার এবং জুলুম ও অবিচারের প্রবল ঝড়ের মোকাবেলায় লৌহপ্রাচীর হয়ে আত্নমর্যাদা ও অবিচলতা এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তার পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। তাকে শাস্তি দেওয়া হত কারাগারের অভ্যন্তরে কিংবা গোপন স্থানে নয়; বরং প্রতিদিন তাকে বাইরে আনা হতো এবং ঘোষক দ্বারা ঘোষনা দেওয়া হতো। যখন লোকেরা জমা হতো, তাদের সামনে প্রতিদিন দশ চাবুক করে মারা হতো। অতঃপর তাকে চতুর্দিকে ঘুরানো হতো। এভাবে একাধারে বারটি দিন শাস্তি অব্যাহত থাকে, একশত বিশ চাবুক পূর্ণ করা হয়। -[মানাকিবে মুয়াফফাক, 2/175]
ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, এই পদ আমি কিভাবে গ্রহন করব? সে যখন কাউকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করবে, সেই নির্দেশ পত্রে আমাকে অনমোদনের স্বাক্ষর করতে হবে। আল্লাহর কসম! আমি এমন পদ কখনো গ্রহন করব না, কখনো না। -[প্রাগুক্ত, 2/24]
অতঃপর উমাইয়ার শাসন যুগ শেষ হয় এবং শুরু হয় আব্বাসী শাসনামল। সর্ব প্রথম আব্বাসী খলীফা হলেন সাফ্ফাহ –[মৃত্যু:135 হিজরী]। অতঃপর ক্ষমতার মসনদে আরোহন করে আবু জাফর মানসূর –[মৃ্ত্যু:158 হিজরী] তার যুগে ইসলামি রাস্ট্রের সর্বশেষ সীমানা ছিল সুদূর চীন দেশের কাশগরের সিংকিয়াং। ‍অর্থাৎ ইসলামি রাস্ট্রের সর্বমোট আয়তন ছিল  আনুমানিক বায়ান্ন লক্ষ বর্গমাইল। তখন খলীফা মানসূর, তার রাজদন্ড ও ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার জন্য এবং সকল শ্রেণীর লোকদেরকে তার দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ইলম ও আমলের ময়দানে প্রতিষ্ঠিত, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর জগৎজোড়া খ্যাতি ও গ্রহনরযোগ্যতাকে মাধ্যম বানানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন। ইমাম আযমের সামনে প্রধান বিচারপতির পদটি পেশ করাকে তিনিও জরুরী মনে করলেন।
আল্লামা খতীব বাগদাদী রহ. লেখেন, আবু জাফর মানসূর ইমাম আবু হানীফা রহ. কে বিচারকের পদ গ্রহনের আবেদন জানালেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করলে তাকে কারারুদ্ধ করে রাখলেন। -তারীখে বাগদাদ, 13/328}
মোল্লা আলী ক্বরী রহ. লিখেন, ‍বিচারকের পদ প্রত্যাখ্যান করায় খলিফা মানসূর ইমাম আযম রহ, কে ত্রিশ চাবুক শাস্তি প্রদান করেন, যার নির্মম আঘাতে তাঁর দেহ তাজা রক্তে  রন্জিত হয় পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত। -[মাসাকিবু সাদরিল আয়িম্মাহ্, 1/215]
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. কে [মৃত্যু 241 হিজরী] যখন তৎকালীন শাসক ফিরকায়ে মু’তাযিলান চক্রান্তের ফলে ”খালকে কুরআন” বিষয়কে কেন্দ্র করে বন্দী করল এবং চাবুকের নির্মম আঘাতে তার দেহকে রক্তে রন্জিত করা হলো, তখন তিনি ইমাম আবু হানীফা রহ. এর হিম্মত ও দৃঢ়তা এবং ধৈর্য ও অবিচলতাকে একটি আদর্শ দৃষ্টান্তের মর্যাদা দিয়ে তাঁর জন্য দোয়া করতেন। -[তারীখে বাগদাদ, 13/372; ইবনে খাল্লীকান, 2/164; মানাকিবে মুয়াফফাক, 2/169]
ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন কোনোভাবেই জালিম শাসকের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত হননি, তখন তাঁকে কারাগারে বিষ পান করিয়ে শহীদ করা হয়। -[তারিখে বাগদাদ, 13/330]
আল্লামা কারদারী লিখেন, অতঃপর মানসূর তাঁকে শূলীর কাষ্ঠে ঝুলিয়ে প্রহার করার নির্দেশ দিল, যাতে তাঁর অঙ্গসমূহে দ্রুত বিষ পৌছে যায়। তাঁর এই ঘৃন্য নির্দেশ পালিত হয় যথাযথভাবে। -[মানাকিবে কারদারী, 2/25]
সারকথা, 150 হিজরীতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ‍সিজদারত অবস্থায় কারাগারের অভ্যন্তরেই তিনি মৃত্যুবরন করেন। কারাগারের কর্মচারীরা বহির্বিশ্বকে একথা বুঝানোর নিষ্ফল চেস্টা করেছে যে, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছ। কিন্তু যাদের অন্তর্দিৃস্টি আছে, তাঁরা দেখেছিলেন এবং যাদের কান আছে তাঁরা শুনেছিলেন। কমবেশী পঞ্চাশ হাজার লোক তাঁর জানাযায় উপস্থিত হয়েছে। আগমনকারীদের ভীড় লেগেই ছিল। একে একে ছয়বার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। দাফনের পর বিশদিন যাবৎ লোকেরা তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে জানাযার নামায আদায় করে। -[মিফতাহুস সা’য়াদাহ্, 2/80; সীরতে নু’মান, 42 শিবলী র.]
●ইবাদাত, পরহেজগারি ও তাকওয়া:
ইতিহাস ও রিজালের গ্রন্থসমূহে ইমাম আযম রহ. এর ইবাদাত, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, হজ্ব ও ওমরা ইত্যাদির ঘটনাবলি তাওয়াতুরের সাথে বর্ণিত আছে। ইমাম আযম রহ. তাঁর জীবনে পঞ্চাশবার হজ্ব করেছেন। -মিফতাহুস সা’য়াদাহ, 2/78; যায়লুল জাওয়াহের, 2/495]
তিনি শুধু এক রমজানেই একশত বিশবার ওমরা করেছেন। গড়ে প্রতিদিন চারবার। -[যায়লুল জাওয়াহের, 2/495
তিনি সারারাত জাগ্রত থাকতেন এবং এক রাকাতেই সমগ্র কুরআন খতম করে  দিতেন। রাতে আল্লাহ ভীতির কারনে রোনাজারীর যে করুন অবস্থা হতো, তা দেখে প্রতিবেশীরা সদয় হয়ে উঠতো। -[তারিখে বাগদাদ, 13/354]
একাধারে চল্লিশ বছর তিনি এশার অযু দিয়ে ফজরের নামায পড়েন। -[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, 10/117; মিফতাহুস সা’য়াদাহ, 2/78]
ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রতি মাসে ষাটবার এবং রমযন মাসে বাষট্রিবার কোরআন কারীম খতম করতেন। -[মিফতাহুস সা’য়াদাহ্, 2/78]
পবিত্র কোরআন খতম করেন সর্বমোট সাত হাজার বার। -[মিফতাহ্, 2/7; যায়লুল জাওয়াহের, 2/493]
এক রাতে কোরআন মাজিদ খতম করা বিস্ময়কর কথা নয়। হযরত ওসমান রাঃ বিতরের এক রাকাতেই সমগ্র কোরআন মাজিদ খতম করতেন। -[তিরমযী শরীফ, 2/118; কিয়ামুল লায়ল, পৃ. 61; যায়লুল জাওয়াহের, 2/493]
হযরত তামীমে দারী রাঃ রাতে পবিত্র কোরআন খতম করতেন। -[তাহাবী, 1/20]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাঃও একরাতে কোরআন খতম করতেন। -[তিরমিযী, 2/118; তাহাবী, 1/105]
হযরত ইমাম শাফেয়ী রহ. রমযান মাসে ষাটবার কোরআন খতম করতেন। -[তাযকিরাতুল হুফফাজ, 1/329]
ইমাম বুখারী রহ. দৈনিক কোরআন খতম করতেন। -[তাবাকাতে কোবরা, 2/9]
●ধার্মিকতা:
ইমাম ওয়াকী ইবনুল জাররাহ্ রহ. বলেন, আমি ইমাম আবু হানীফা রহ. এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। একটি মেয়ে বিক্রির জন্য তাঁর কাছে রেশমি কাপড় নিয়ে আসলো। তিনি বললেন, মূল্য কত? সে বলল, একশত ‍দিরহাম। ইমাম সাহেব বললেন, এর মূল্য একশতেরও অধিক। সে বলল, ঠিক আছে দুইশত দিরহাম। তিনি বললেন, না এর দাম আরো বেশী। অবশেষে তার ন্যায্য মূল্য নির্ধারিত হল পাঁচশত ‍দিরহাম। এবং সে মূল্যেই তিনি কাপড় ক্রয় করলেন। -[মানাকিবে মুয়াফফাক, 1/122]
একদা ইমাম আযম রহ. এর গোলাম তাঁর মালে ব্যবসা করে ত্রিশ হাজার দিরহাম অর্জন করল। কিন্তু তাঁর ধারনা ব্যবসায় ত্রুটি ছিল। তাই ত্রিশ হাজার দিরহাম সম্পূর্ণরূপে গরিবদের মাঝে বন্টন কিরে দিলেন। -প্রাগুক্ত, 1/203]
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বর্ণনা করেন, একদা লুন্ঠনকৃত কিছু ছাগল কূফার বাজারে আসে এবং কূফাবাসীর ছাগলের সাথে মিশে যায়। ইমাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ছাগল সর্বোচ্ছ কতদিন বেচে থাকে? লোকেরা বলল, সাত বছর। তিনি এই ঘটনার পর থেকে একাধারে সাত বছর  ছাগলের গোস্ত পরিত্যাগ করেন। -[প্রগুক্ত, 1/205]
ইমাম ইবনে হাজার মক্কী রহ. বলেন, মূলত শুধুমাত্র একটি বকরি কূফার বকরীগুলোর সাথে মিশে গিয়েছিল। ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি শেষে লেখেন, যেহেতেু এই বকরীটি সাত বছর যাবৎ বেচে থাকার সম্ভাবনা ছিল এবং তার গোস্ত ভক্ষনের কারনে অন্তরে জুলমাত সৃস্টি হতো, তাই তিনি একমাত্র তাকওয়া ও খোদাভীতির কারনেই এত দীর্ঘ সময় বকরির গোস্ত বর্জন করেছেন। -[আল খায়রাতুল হিসান, পৃ. 7]
●আমানত ও বিশ্বস্ততা:
আবু সুফিয়ান ইবনে ওয়াকী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. অনেক বড় আমানতদার ছিলেন। -[মানাকিবে মুয়াফফাক, 1/320]
একদা জনৈক ব্যবসায়ী এক লাখ সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর কাছে আমানত রাখে। -[প্রগুক্ত, 1/222]
তিনি যখন শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন, তখন তার গৃহে লোকদের পাঁচ কোটি দিরহাম আমানত ছিল। -[প্রগুক্ত, 1/220]
গায়রে মুকাল্লিদ লেখক হাফেজ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহিম আল ওয়াযীর [মৃত্যু: 840 হিজরী] লিখেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মর্যাদা ও আদালত, তাকওয়া ও আমানতদারিতা তাওয়াতুর সূত্র পরম্পরায় প্রমানিত। -[আর রাওযুল বাসেম, 1/158]
●মাকবূলিয়্যাত বা গ্রহনযোগ্যতা:
আল্লামা আমীর শাকীর আরসালান [মৃত্যু; 1366 হিজরী] বলেন, মুসলমানদের সিংহভাগ ইমাম আবু হানীফা রহ. এর অনুসারী ও মুকাল্লিদ। অর্থাৎ তুরস্ক ও বলকানের মুসলমান, রাশিয়া, আফগানিস্তান ও চীনের মুসলমান, হিন্দুস্তান ও আরবের অধিকাংশ মুসলমান, ‍সিরিয়া ও ইরাকের অধিকাংশ মুসলমান ‍ফিকাহ্ শাস্ত্রে হানাফী মালেকীর অনুসারী। -[হাশিয়ায়ে হুসনুল মাসা’য়ী, পৃ. 69]
বিশিস্ট সমালোচক আল্লামা যাহাবী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা ইরাকের একজন বড় ফকিহ্। -[কাযকিরাতু হুফফাজ, 1/158]
গায়রে মুকাল্লিদ দলের শায়খকুল মাওলানা সায়্যেদ নাযীর দেহলভী রহ. বলেন, মুজতাহিদ ও সুন্নাতের অনুসারী এবং মুত্তাকী ও পরহেজগার হওয়াই তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ঠ। -[আল হায়াত বা’দাল মামাত, পৃ. 593]
সারকথা হল, ইলম ও আমলের ময়দানে তাঁর মান ও মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা আমন আলোকোজ্জল যে, ফিকহী দৃস্টিকোণ থেকে মতবিরোধকারীরাও তার প্রশংসা ও গুনকীর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বায়তুল হিকমার পরিচয়:

আব্বাসীয় যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ

ইবনে কুতাইবার জীবনী