আব্বাসীয় যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ



●ভূমিকা:
আব্বাসীয় যুগে মুসলিম কৃস্টি, সভ্যতা ও জ্ঞানানুশীলন বিশ্ব সভ্যতার শীর্ষদেশে ‍উন্নীত হয়েছিল। এ কারনে এ যুগকে জ্ঞান বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। প্রাচীন সভ্যতায় বিলুটপ্ত উপকরন সংগ্রহ ও সংরক্ষন করে আব্বাসীয় ‍যুগের মনীষীগন সভ্যতার অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। আব্বাসীয় খলীফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা পরিচালিত হয়।
● ভূগোল: কেবলা ‍নির্ধারন, পবিত্র হজ্ব পালন প্রবৃতি ধর্মীয় কারনে মুসলমানগন ভূগোল চর্চা শুরু করে। জোতির্বিদ্যার গবেষণার জন্য সকল স্থানের অক্ষাংশ এবং দ্রঘিমাংশ নির্ণয়ের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সমূদ্র বানিজ্যে আরবদের বিশেষ প্রাধান্য থাকায় ভৌগলিক জ্ঞানের গুরুত্ব কম ছিল না। তারাই সর্ব প্রথম দিক দর্শন ও দূর্বিন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। প্রখ্যাত গ্রীক ভৌগলবিদ টলেমীর গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। এ ক্ষেত্রে ইয়াকুব ইবনে ইসহাক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রীক গ্রন্থের সাহায্যে খলীফা মামুনের রাজত্বে আল খাওয়ারিজমী কর্তৃক ”সূরত আল আরদ” নামে একটি গ্রন্থ মানচিত্র প্রণীত হয়। সর্বমোট 67 জন মনীষী এ গ্রন্থ প্রণয়নে অংশগ্রহন করেন। যেখানে ইউরোপীয় ভৌগলবিদগন পৃথিবী চ্যাপটা বলে মন্তব্য করেন, সেখানে মুসলিম ভৌগলবিদগন পৃথিবীর গোলত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
মুসলিম ভৌগলবিদগন দেশ বিদেশে ভ্রমন করে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেন। পারস্যের খুরদাদবিহ ছিলেন প্রথম মুসলিম ভূগোল বিবরন বেত্তা। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “আল মাসালিক ওয়াল মামালিক” 846 খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। 891 খ্রীস্টাব্দে আল ইয়াকুবী ”কিতাব আল বুলদন”, 906 খ্রীস্টাব্দে ইবনে রুশতাহ্ “আল আলাক আন্ নাফিসা” রচনা করেন। আল মাসুদী অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরব ভৌগলবিদ ছিলেন। খৃস্টীয় দশম শতাব্দীতে তিনি সমগ্র এশিয়া মহাদেশ, জানজিবার এবং উত্তর আফ্রীকা ভ্রমন করে ত্রিশ খন্ডের “মুরুয আদ দাহাব” গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁকে আরবদের হিরোডোটাস বলা হয়েছে। অপরাপর ভৌগলবিদ ও মানচিত্র প্রণয়নকারীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল ইস্তাখারী, ইবনে হাওকাল এবং মাকদিসী। আল বিরুনী তাঁর ”কিতাবুল হিন্দ” গ্রন্থে ভারত বর্ষের সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেন। ভ্রমন বৃত্তান্তের ক্ষেত্রে ইবনে বতুতা অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। তিনি ত্রিশ বছর আরবদেশ, চীন সিংহল, পারস্য, বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ ও মধ্য আফ্রিকায় ভ্রমন করে একটি নির্ভরযোগ্য ভ্রমন কাহিনী লিটিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
●ইতিহাস: ইতিহাস চর্চা মূলত উমাইয়া খেলাফতে শুরু হলেও আব্বাসীয় ‍যুগে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এর উৎকর্ষ সাধিত হয়। মৌখিক উপাখ্যান, প্রাক ইসলামি আরবের কাহিনী, রাসূলে কারীমের জীবনী আরব ইতিহাসের সর্বপ্রথম বিষযবস্তু ছিল। প্রাক ইসলামিক যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ছিলেন হিশাম আল কালবী। মুহাম্মাদ  ইবনে ইসহাক রাসূলে কারীমের জীবন বৃত্তান্ত রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। তিনি ছাড়াও রাসূলের জীবনী রচয়িতা হিসেবে ইবনে হিশাম এবং আল ওয়াকিদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে সাদ রাসূল এবং তাঁর সাহাবীদের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। মিসরের ইবনে আবদুল হাকামের রচিত “ফুতুহ মিসর ওয়া আখবারুহু” গ্রন্থ মিসর, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন বিজয়ের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ। পারস্যবাসী বালাজুরী তাঁর ”ফুতুহ ই বুলদান” এবং ”আনসাব উল আশরাফ” নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের পর আরবগনই ইতিহাস চর্চায় বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে। খলীফাগন ইতিহাস চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ইবনে কুতাইবা ”কিতাব আল মা’রিফ” ‍”দিনওয়ারী” ”আল আখবার আত তিওয়াল” রচনা করেন। সমালোচনা মূলক ইতিহাস রচনায় হামজা আল ইস্পাহানী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আরব ঐতিহাসিকদের মধ্যে আত তাবারী  উজ্জল সক্ষত্র। তিনি ”তারিখ আর রাসূল ওয়াল মুলূক” শীর্ষক একটি তথ্য ভিত্তিক ইতিহাস রচনা করেন। পৃথিবীর জন্ম থেকে 915 খৃস্টাব্দ পর্যন্ত  ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করার জন্য তিনি পারস্য, মিশর, সিরিয়া ও ইরাক ভ্রমণ করেন। তাবারীর মত কালক্রম ভিত্তিক ইতিহাস রচনা না করে আল মাসূদী রাজবংশ ভিত্তিক ইতিহাস রচনা করেন। তাঁর পদ্ধতি পরবর্তীকালে ইবনে খালদুন ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগন অনুসরন করেন। নিঃসন্দেহে ইবনে খালদুন ছিলেন আরবদের মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক। হিট্রি তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক দার্শনিক বলে উল্লেখ করেছেন।  তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের ”মুখবন্ধ”, ”মুকাদ্দামা” বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ক্রম বিবর্তনের দ্বারা মানব সভ্যতার দিক উন্মোচন করে। আরব ইতিহাস চর্চায় ইবনে খাল্লিকান বিশেষ অবদান রাখেন।
●দর্শন শাস্ত্র: আব্বাসীয় যুগে দর্শন শাস্ত্রের চর্চা এক নব দিগন্তের সূচনা করে। দর্শন হল যৌক্তিক পদ্ধতিতে সত্যে উপনীত হওয়ার পন্থা। গ্রীক চিন্তাধারায় প্রাচ্যের প্রভাব মুসলমানদের মনে পরিশুদ্ধি লাভ করে এবং আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আরবি দর্শনের সৃস্টি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আরবি দর্শন কোরআন ও হাদিসভিত্তিক হলেও পরবর্তী পর্যায়ে গ্রীক ও পারস্য দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইসলামি দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হযরত আলী রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ, ইমাম গজ্জালী রহ.। গ্রীক তথা এরিস্টটল পন্থি আরব দার্শনিকদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেন আল কিন্দি, আল ফারাবী, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ। আরবদের দার্শনিক নামে খ্যাত আল কিন্দি এরিস্টটল এবং প্লেটোর দর্শনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেস্টা করেন। তিনি একাধারে জ্যেতির্বিদ্যা, রসায়ন, চক্ষু চিকিঃসা ও সংগীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর সর্বমোট 265 টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইউক্লিডের ‘অপটিকস’ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে প্রণীত গ্রন্থটি ইবনে হিশামের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে সমাদৃত ছিল। আল কিন্দির এ গ্রন্থ রজার বেকনকেও প্রভাবিত করেছিল। হিট্রির ভাষায়, “ইসলামের সাথে গ্রীক দর্শনের যে সমন্বয় আরববাসী আল কিন্দি শুরু করেন তা তুর্কী আল ফারাবী এবং পারস্যবাসী ইবনে সিনা সুদূরপ্রসারী করেন। আল ফারাবীর প্রখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য “রিসিলাত ফিল হিকমা”। তিনি এরিস্টটলের রিপাবলিকান এবং পলিটিকস দ্বারা প্রভাবিত হন। সংগীত বিসারদ হিসেবেও আল ফারাবী খ্যাতি অর্জন করেন এবং সংগীতের উপর তার লিখিত প্রামান্য গ্রন্থের নাম “কিতাব আল মাউসিকি আল কাবির”। কথিত আছে যে, তিনি বীণা বাজিয়ে তাঁর শ্রোতাদেরকে কাঁদাতে, হাঁসাতে এমন কি ঘুম পাড়াতে পারতেন। কিন্তু দর্শন শাস্ত্রে আল ফারাবির অবদান ছিল সর্বাধিক। তিনি ইবনে সিনা, আল ফারাবীর দর্শন ও চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁকে জ্ঞানী গুনীদের মধ্যে আল শেখ, আল রাইস বলা হয়েছে। তিনি একাধারে ছিলেন চিকিৎসাবিদ, দার্শনিক ভাষাতাত্ত্বিক এবং কবি।
●চিকিৎসা শাস্ত্র: আব্বাসীয় খিলাফতে চিকিৎসা শাস্ত্রের যথেস্ট উন্নতি হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে গ্রীক গ্রন্থ থেকে অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক গ্রন্থ প্রণয়নের ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। প্রথম যুগে প্রখ্যাত চিকিৎসকদের মধ্যে বিশেষভাবে কৃতিত্ব অর্জন করেন যুহান্না বিন মাসাওয়া এবং হুনায়েন বিন ইসহাক। সব ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ হওয়ায় মানুষের পরিবর্তে বানর নিয়ে গবেষণা করা হত। এ দু’জন পন্ডিত চক্ষু শাস্ত্রের উপর প্রামান্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁদের ঔষধপত্রের বিধান সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। হারুন ও মামুনের রাজত্বকালে জিব্রাইল ইবনে বখতিয়াসু একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁর বংশধরেরা আব্বাসীয় খলীফাদের পারিবারিক চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করেন। আরবি রসায়ন শাস্ত্রের জনক জাবের ইবনে হাইয়ান ঔষধ প্রস্তুত প্রণালীর উপর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন। আব্বাসীয় খিলাফতে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা শাস্ত্রের যথেষ্ঠ উন্নতি সাধিত হয়। আল মুকতাদির আমলে 931 খৃস্টাব্দে সিনান বিন সাবেদ বিন মুররাহকে চিকিৎসকের পেশাগত যোগ্যতা নির্ণয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এ পরীক্ষায় 860 জন চিকিৎসক উত্তীর্ণ হন। সম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ”বিমারিস্তান” বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী চিকিৎসা বিজ্ঞারে যারা অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন তারা হচ্ছেন, আলী আত্ তাবারী, আর রাজী  এবং ইবনে সিনা। তাবারী চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থটি গ্রীক ও হিন্দু চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। আর রাজীকে নিঃসন্দেহে মুসলমান ‍চিকিৎসকদের মধ্যে সবচাইতে মেধাবী বলা হয়ে থাকে। তিনি 113 টি বড় এবং 28 টি ছোট গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দশ খন্ডে ”কিতাব আল মানসূরী” প্রণয়ন করেন এবং এর একটিতে সর্ব প্রথম বসন্ত ও হামের উপর বিশদ বর্ণানা ছিল। মূলত দার্শনিক হলেও ইবনে সিনা চিকিৎসা শাস্ত্রে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ”কানুন ফিত তিব্ব” গ্রীক ও আরবীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি সমনন্বয়। এ গ্রন্থে ক্ষয়রোগের সংক্রামন প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা ছাড়াও 770 প্রকারের ঔষধ প্রস্তুতের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ ছিল। ’কানুন’ দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রিমনার  জিরার্ড কতৃক অনূদিত হয় এবং এর ফলে এ গ্রন্থটি ইউরাপে চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
●জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষ শাস্ত্র: জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত জ্যোতিষ শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান বিস্ময়কর। আল মানসূরের আমলে ভারতীয় সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত’ আরবিতে অনূদিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে গ্রীক জ্যেতির্বিদ্যার প্রভাব অনুপ্রবেশ করে টলেমীর আল মাজেস্ট’র অনুবাদের মাধ্যমে। এর অনুবাদ সম্পন্ন করেন হাজ্জাজ বিন মাতার এবং হুনাইন ইবনে ইসহাক। জ্যোতিষ শাস্ত্রের গবেষণা ও চর্চার জন্য জুন্দিশাহপুর ও বাগদাদে মানমন্দির নির্মিত হয়। গ্রীক পদ্ধতিতে ইব্রাহিম আল ফাজারী প্রথম এসট্রোলেবল তৈরী করেন। এছাড়া ডায়াল, কোয়াড্রান্ট, সীজ বা জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সারণী বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আরব জ্যোতিষীদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেন আল মাজরিতি, আল ফারগানী, আবদুর রহমান আস সূফী, আল বাত্তানী, আল বিরুনী, আল খাওয়ারিজমী। আল বাত্তানী সূর্যের আংশিক গ্রহন, ক্রান্তিবৃত্তের বক্রতা, সূর্যের কক্ষপথ, বছর এবং রৃতুর দীর্ঘতা সম্পর্কে গবেষণা করে নতুন ব্যাখ্যা দেন। আল বিরুনী কিতাবুল হিন্দ এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপর প্রামান্য গ্রন্থ রচনা করেন। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের আমলে নিশাপুরের মানমন্দিরে ওমর খৈয়াম গবেষণারত ছিলেন। তাঁর প্রচেস্টায় ’জালালী’ পন্জিকা প্রণীত হয়। নাসিরুদ্দীন তূসী পরিচালিত মারাগার মানমন্দিরে 4,00,000 গ্রন্থ সংবলিত একটি গ্রন্থাগার ছিল। জ্যোতির্বিদ আল মাশারের চারটি গ্রন্ধ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ‍তিনি সর্ব প্রথম চন্দ্র-সূর্যের প্রভাবে জোয়ার ভাটার কারন নির্ণয় করেন।
●গণিত শাস্ত্র: গ্রীক ও ভারতীয় প্রভাবে আরবি গণিত শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। সিদ্ধান্ত গ্রন্থটি অনুবাদের ফলে মুসলমান বিজ্ঞানীগন ভারতীয় হিন্দু অংক শাস্ত্র, সংখ্যারীতি এবং শূন্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। তারা টলেমীর প্রখ্যাত গ্রন্থ আল মাজেস্ট এর সূত্রগুলো বিশ্লেষল করে সেগুলোর অসারতা প্রমান করেন। গণিত শাস্ত্রে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন ”আল কাফী ফিল হিসাব” গ্রন্থের প্রণেতা আল ফাজারী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আরব অংক শাস্ত্রবিদ আল খাওয়ারিজমী। জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় সূত্রাবলী ব্যতীত আল খাওয়ারিজমী অংক এবং বীজগণিতের উপর গবেষণামূলক তথ্য আবিষ্কার করেন। হিট্রি বলেন, দ্বাদশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত খাওয়ারিজমীর এই বইখানি তথা হিসাব আল জাবর আল মুকাবালা কে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য করা হত এবং এর মাধ্যমে ইউরোপের বীজ গণিতের ব্যবহার প্রবর্তিত হয়। আল খাওয়ারিজমীর সংখ্যারীতি বা algorisms সর্বজন স্বীকৃত ছিল। বীজগণিত ছাড়াও জ্যামিতি এবং ‍ত্রিকোণমিতিতেও মুসলিম মনীষিগন যথেষ্ঠ অবদান রেখেছেন।
●রসায়ন শাস্ত্র: হিট্রি বলেন, ”মেটিরিয়ামেডিকা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিত শাস্ত্রের পরে আরবগন রসায়ন শাস্ত্রেই সর্বাপেক্ষা অধীক অবদান রাখেন।” আরব রসায়ন শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জাবির ইবনে হাইয়ান এবং আর রাজীর পরেই তিনি সর্বাপেক্ষা খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রীক ও মিশরীয় পন্ডিতদের মত তিনিও মনে করতেন যে, অজ্ঞাত পদার্থের সাহয্যেই টিন, লৌহ, সীসা ও তামা প্রভৃতি নিকৃষ্ট পদার্থগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যে রূপান্তরিত হয়। জাবির তার বাইশখানা গ্রন্থে রাসায়ন শাস্ত্রের সব বিষয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করেন। এগুলোর মধ্যে কিতাব আল রহমা, কিতাব আল তাজমী এবং আল জিবাক আল সারকী। চতুর্দশ শতাব্দীর পরে এশিয়া ও ইউরোপে তার রচিত গ্রন্থাবলী রাসায়ন শাস্ত্রের প্রামান্য গন্থরূপে ব্যবহৃত হয়। ‍তিনি রসায়ন শাস্ত্রের দুটি সূত্র-ভস্মীকরন ও লঘুকরন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়াও বাস্পীকরণ ও উর্ধ্বপাতণ,ন তরলীকরণ, স্ফটিকীকরণ প্রভৃতি সূত্রের উৎকর্ষতা তিনি সাধন করেন। হামবুলট বলেন, আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র মুসলামনদেরই আবিস্কার বলা যায় এবং এদিক দিয়ে তাদের কৃতিত্ব অতুলনীয়।
●কাব্য সাহিত্য: কাব্য চর্চা ও সাহিত্য সৃস্টির ক্ষেত্রে আব্বাসীয় খেলাফতে একটি গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময় আরবি ও ফার্সি সাহিত্য চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। আরবি সাহিত্যে আবুল ফারাজ, ইবনে খাল্লিকান, আবু নাওয়াস ও উতবী বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। আরবি অপেক্ষা ফার্সি সাহিত্য ‍অধিকতর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ফার্সি সাহিত্যে যেসব যেসব পারস্য কবি অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন তাদের মধ্যে ফেরদাউসী, ওমর খৈয়াম, নিযামী, সা’দী, রূমী ও হাফিজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবি সাহত্যের দিকপাল ছিলেন হামজা আল ইস্পাহানী। তিনি কিতাব আল আগানী রচনা করে মুসলিম সভ্যতার একটি তথ্য নির্ভর বর্ণনা দেন। আব্বাসীয় খেলাফতে খলীফা হারুন অর রশীদের সময়ে কাহিনী সম্বলিত ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ রচিত হয়। অবশ্য পরে ভারতীয় গ্রীক ও মিসরীয় উপাদান আরব্য উপন্যাসে সংযোজিত হয়। আরব্য উপন্যাস বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এর ফলে ইউরোপীয় সাহিত্যে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে নাবিক সিন্দাবাদের অনুকরনে গ্যালিভারের ভ্রমন কাহিনী রচিত হয় বলে অনেকে মত পোষণ করেন।
●শিল্পকলা: আব্বাসীয় যুগে মুসলিম স্থাপত্য, চিত্রকলা, মৃৎশিল্প, কার্পেট শিল্প, হস্তলিপিরীতি, অলংকরণ শিল্প চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। পারস্য স্থাপত্যকলার প্রভাবে এ সময়ে বাগদাদ, রাক্কা, উখাইদীর, বুলকাওয়ারা প্রাসাদ নির্মিত হয়। সেলজুকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদ স্থাপত্বে বিকাশ ঘটে, যার নিদর্শন দেখা যাবে ইসফাহানে। আল মু’তাসিমের সামাররা অর্থাৎ ”সুররা মান রা” আব্বাসীয় স্থাপত্যকলার অনুপম দৃষ্টান্ত এবং সামারার জামে মসজিদ ও আবু দুলাফের মসজিদ আজেও কালের সাক্ষর বহন করে। পান্ডুলিপি চিত্রায়ণ আব্বাসীয় চিত্রকলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মেসোপটেমীয় চিত্রশালায় কালীলা ওয়া দিমনা, মাকামাত, শাহনামা চিত্রিত হয়। দেওয়াল চিত্র ও মোসাইক এর নিদর্শন পাওয়া যায় জাওসাক আল খাকানীর প্রসাদে। আব্বাসীয় যুগে পারস্যে মৃৎশিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। এ সময়ে কাসানে রঙ্গিন নকশাকৃত যে মৃত পাত্র তৈরী হয় তা কাশী নামে পরিচিত ছিল। আলেপ্পো, দামেস্ক, এন্টিওকে এনামেল ও গিল্টি করা পাত্র তৈরী হত। ধাতব পাত্র নির্মাণে কারুশিল্পিগন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এ যুগে ইসলামী শিল্পকলা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। খলিফা আল মামুনের রাজত্বকালে আল রায়হান যে লিখনরীতি আবিষ্কার করেন তা রায়হানী লিপি নামে প্রচলিত ছিল। আব্বাসীয় যুগে ‍দুজন লিপিশিল্পি হলেন, ইবনে মুকলাহ ইবনে আল বাওয়াব। আব্বাসীয় যুগে সাহিত্য চর্চা চরম আকার ধারন করে। আল মাহদী আল হারুনের রাজত্বকালে ইব্রাহিম আল মাউসিলি সংগীত চর্চায় অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছড়ির আঘাতে সূর সৃস্টি করতে পারতেন। খলিফা মামুনের দরবারে সংগীত শিল্পি ছিলেন ইসহাক ইবনে ইব্রাহিম আল মাউসিলি। আল আল ফারাবী তার কিতাব আল মাউসিকী আল কাবীর গ্রন্থে সংগীতের উপর তথ্য সম্বলিত বিবরন দেন।
●জ্ঞান চর্চার প্রসারতা: আব্বাসীয় খেলাফতে জ্ঞান চর্চার জন্য মাদরাসা, মক্তব ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা শিক্ষাদান করেতেন। কুরআন ও হাদীস ছাড়াও আরবি ব্যাকরণ, কবিতা, ভাষাতত্ব, ইতিহাস এবং অংক পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আল মামুনের খেলাফতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ও গবেষাণাগার ছিল বায়তুল হিকমা। ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় বাগদাদে। মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুলুক 1065 খৃস্টাব্দে নিযামিয়া মাদরাসা নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর অনুকরনে 1234 খৃস্টাব্দে আল মুসতানসিরের খেলাফতে বাগদাদে দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এটি মুসতানসারিয়া নামে পরিচিত  ছিল। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল আক্রমনকারী হালাকু খানের বাহিনী এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে। উল্লেখ্য যে, ইমাম গাজ্জালী চার বছর নিযামিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আব্বাসীয় সম্রাজর বিভিন্ন শহরে মাদরাসা স্থাপন করে জ্ঞান চর্চার পথ সুগম করা হয়। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে যোবায়েরের বর্ণনা অনুযায়ী বাগদাদে ত্রিশটি, দামেস্কে বিশটি, মসুলে ছয়টি শিক্ষায়তন ছিল। জ্ঞান বিস্তারের জন্য বিভিন্ন গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগদাদের বায়তুল হিকমা ছিল সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। এ সময়ে কাগজের প্রচলন হয় এবং চীনা কাগজের অনুকরনে সমরকন্দে একটি কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়। ইয়াকুবের ভাষ্য অনুযায়ী, রাস্তার দু’পাশে বইয়ের দোকান ছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বায়তুল হিকমার পরিচয়:

ইবনে কুতাইবার জীবনী