ইবনে কুতাইবার জীবনী


●ইবনে কুতাইবার পরিচিতি:
তাঁর নাম আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে কুতাইবা আদদীনওয়ারী। তিনি একজন সাহিত্যিক, হাফেজে হাদিস ও মেধাবী আলেমদের অন্যতম। ধারাবাহিকভাবে তিনি ভাষা, সাহিত্য, হাদিস ও ইতিহাসের ইমাম ছিলেন। তিনি বর্ণনায় সর্বদা সত্যবাদী ছিলেন। কোরআন ও হাদিসের দূর্বোদ্ধতম অর্থ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহা পন্ডিত ছিলেন। সুক্ষ কবিতা এবং গজল রচনায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। পরিপূর্ণ  বোধ শক্তির অধিকারী ছিলেন। সত্য বলায় নির্ভীক ছিলেন। তিনিই প্রথম যিনি সাহিত্য সমালোচনার ‍উপরে সাহিত্যে লিখিত বইয়ের চাইতেও অধিক বই রচনা করেছেন। তার বইগুলোকে সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যের বইগুলোর মা বলা হয়ে থাকে। একারনে ঐতিহাসিকগন তাঁর জীবনী দীর্ঘ করে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন।
●জন্ম ও বেড়ে উঠা:
তাঁর পিতা ”মারু” শহরের অধিবাসী ছিলেন। কুতাইবার জন্ম তারিখে সামান্য এখতেলাফ আছে। ইবনুল আম্বারী, ইবনুন নাদীম এবং ইবনুল আছীর প্রমূখের মতে, তিনি কূফায় জন্ম গ্রহন করেন। আর বাকিদের তথা আস সামআনী এবং আল কুফতী প্রমূখের মতে, তাঁর জন্ম বাগদাদে 213 হিজরীতে। সেখানেই বেড়ে উঠেন এবং সভ্যতা সংস্কৃতি গ্রহন করেন। সেখানকার আলেম ও জ্ঞানীগুনীদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। দীন্ওয়ারে শাসক থাকা অবস্থায় তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। সেদিকে সম্বন্ধ করে তাঁকে দীনওয়ারী বলা হয়। তাঁকে আল মারূযীও বলা হয়। ইবনে কুতাইবা বাগদাদেই বড় হন। বাগদাদ তখন জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। তিনি জ্ঞানার্জনে মনযোগী হন এবং সেখানকার বড় বড় মহাদ্দিস, রাভী ও ভাষাবিদ এবং সাহিত্যিকদের নিকট থেকে শিক্ষার্জন করেন। এতে তিনি আবু ইসহাক আয যিয়াদী, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, আবু হাতেম আস সিজিসতানী, আবুল ফদল আর রাইয়াশী, আবদুর রহমান ইবনে আখী আল আছমাঈ ও হারমালা ইবনে ইয়াহইয়া এবং আবুল খাত্তাব যিয়াদ ইবনে ইয়াহয়া আল হাসসানীর মত বড় বড় মহাদ্দিসগন থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের সময় তার লিখিত কিতাব বাগদাদে পড়ানো হত। তাঁর লিখিত কিতাবাদি ছিল জ্ঞান পিপাসুদের জন্য সমূদ্র স্বরূপ।
●ইবনে কুতাইবার শীষ্যবর্গ:
তাঁর থেকে যারা শিক্ষা গ্রহন করেছেন, তাঁর পুত্র কাজী জাফর আহমাদ বিন কুতাইবা ফকীহ আদীব, আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বিন জাফর আল ফাসাভী, আবীদুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ আস সুক্কারী, মুহাম্মাদ বিন আইয়্যুব প্রমূখের মত বড় বড় আলেমগন তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহন করেন।
●ইবনে খাকানের সাথে ইবনে কুতাইবার ঘনিষ্ঠতা:
সে সময়কার আব্বাসীয় শাসক আবুল হাসান আবীদুল্লাহ বিন ইয়াহয়া বিন খাকানের সাথে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁকে উৎসর্গ করে তাঁর বিখ্যাত কিতাব ”আদাবুল কাতেব“ টি রচনা করেন।
এতে বাদ্শা খুৎবায় তাঁকে উল্লেখ করেন এবং প্রশংসা করেন।
●ইবনে কুতাইবার আকীদা:
তাঁর আকীদার ব্যাপারে আলেমগন প্রচুর এখতেলাফ করেছেন। ইবনে তাইমিয়া বলেন, তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। ইবনে তাইমিয়া তাঁর তাফসীর গ্রন্থে সূরা এখলাসের তাফসীরে ইবনে কুতাইবার রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন। হাফেজ শামসুদ্দীন যাহাবী তাঁর মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে লেখেন, যুগের আয়নায় দেখেছি যে ইমাম দারু কুতনী বলেন,” ইবনে কুতাইবা মুশাব্বিহার দিকে ঝুকতেন। তার কথাতেই সেটি বুঝা যায়”। তবে জালালুদ্দীন সুয়ূতী এবং দাউদী তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, মুশাব্বিহার বিরুদ্ধে তিনি তা‘বীলু মুখতালাফিল হাদীস কিতাবটি রচনা করেছেন। খতীবে বগদাদী তার তারীখে বাগদাদে বলেন, তিনি দীনদার, বিশ্বস্ত এবং জ্ঞানী ছিলেন।
ইবনে কুতাইবার জ্ঞান:
যে সকল জীবনীকারকগন ইবনে কুতাইবার জীবনী লিখেছেন সকলেই বলেছেন, তিনি জ্ঞানী, সাহিত্যিক ও হাফেজে হাদীসদের অন্যতম ছিলেন। তিনি আরবি, ভাষা ও ইতিহাসের পন্ডিত ছিলেন। কোরআনের গভীরতম মর্ম, সুক্ষ কবিতা ও ফিকাহ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। তার বহু রচনা এবং সংকলন রয়েছে। ইমাম নবভী তাঁর তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত গ্রন্থে বলেন, আমি তার কিতাবের শিরোনামগুলো পড়েছি। তবে সবগুলো আমার মনে নেই। কিন্ত আমার ধারনা তা ষাটের অধিক হবে। আত্ তাহদীস বিমানাকিবি আহলিল হাদীস গ্রন্থে আছে, তাঁর লিখিত কিতাবের সংখ্যা তিনশর বেশী।
ইবনে কুতাইবার রচনাবলি:
1.     গারীবুল কুরআন। এতে কুরআনের শব্দগত গভীরতার সমাধান আলোচনা করা হয়েছে।
2.     মুশকিলুল কুরআন। এতে কুরআনের দূর্বোদ্ধ উদ্দেশ্যের উন্মেমাচন করা হয়েছে।
3.     মায়ানিল কুরআন।
4.     কিতাবুল কেরায়াতি।
5.     তাবাকাতুশ শুয়ারা
6.     আর রাদ্দু আলাল কা‘ইলি বিখালকিল কুরআন।
7.     কিতাবুল ইমামাতি ওয়াস সিয়াসাতি।
8.     গারিবুল হাদিস।
9.     উয়ূনুল আখবার
10.তাবীলু মুখতালাফিল হাদীস।
11.দিওয়ানুল কুত্তাব।
এ ছাড়াও আরো অনেক কিতাব আছে তাঁর। এখানে অনুল্লেখই থাকল।
●ইবনে কুতাইবার ইন্তেকাল:
ইবনে খাল্লিকান বলেন, তিনি সত্তর বছর বয়সে যুলকাদ মাসে ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ বলেন, একাত্তর বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ বলেন, তার মৃত্যু দুইশত চুয়াত্তর হিজরীতে রজব মাসে হয়। তবে এটাই অধিক বিশুদ্ধ মত। তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল হঠাৎ করে। প্রচন্ড চিৎকার করতেছিলেন, করতে করতে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। পরে মারা যান। বর্ণিত আছে, তিনি হারিসা (চূ্র্ণ গম ও গরুর মাংস দিয়ে তৈরী এক প্রকার খাদ্য) খেয়েছিলেন। তখন তিনি ভিষন গর্মিত হন এবং চিৎকার করতে করতে বেহুঁশ হয়ে যান এবং কাঁপতে থাকেন। অতঃপর কিছুটা সুস্থ হয়ে তাশাহ্হুদ পড়তে পড়তে সাহরীর সময় ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহমত বর্ষন করুন।
(জীবনীটি  ইবনে কুতাইবার লিখিত উয়ূনুল আখবার ‍কিতাবের তরজমাতুল মুসান্নেফ থেকে অনুবাদকৃত)

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বায়তুল হিকমার পরিচয়:

আব্বাসীয় যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ