বায়তুল হিকমার পরিচয়:
●ভূমিকা:
শিক্ষা সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আব্বাসীয়
আমলে এক অদ্বিতীয় অধ্যায়। এ আমলে প্রকৃত অর্থে ইসলামি সভ্যতার উন্মেষ ও ক্রমবিকাশ ঘটে।
তাদের অনুসন্ধিৎসা, বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি একনিষ্ঠ অনুরাগ, জ্ঞান স্পৃহা প্রভৃতি কারনে
তারা গড়ে তোলে এক অতুলনীয় বিজ্ঞানাগার। যা ইতিহাসে বায়তুল হিকমা নামে পরিচিত। এই অদ্বিতীয়
বিজ্ঞানাগারের মাধ্যমে আব্বাসীয় আমলে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা দীক্ষা কৃষ্ঠি ও সভ্যতার
চরম উৎকর্ষ সাধন করে তারা শুধু স্বর্ণ যুগেরই সূচনা করেননি, বরং অবলুপ্ত প্রাচীন মানবসভ্যতার
ধারক ও বাহক হিসেবে তারা বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রাখতে সক্ষম হন।
●বায়তুল হিকমার প্রতিষ্ঠা:
আব্বাসীয় খলীফা আল মানসূর (758-775 খৃ.) জ্ঞান চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তি,
কৃষ্টি ও সভ্যতার যে বীজ বপন করেন, তা তাঁর উত্তরসূরী হারূন অর রশীদের (786-809 খৃ)
প্রযত্নে অঙ্কুরিত হয়ে বৃদ্ধি পায় এবং পরিশেষে মামুনের আমলে সুস্বাদু ও সুবৃহৎ ফলভারে
নত মহীরুহরূপে পরিণত হয়। মামুন গ্রীক জ্ঞান ভান্ডার হতে উপকরন আহরনের জন্য ইবন মাসাওয়া
এবং হুনাইন ইবনে ইসহাকের নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল ও সিসিলি হতে আহরিত পান্ডুলিপি এবং
এটি ছাড়াও সংস্কৃত, পারস্য, ভারতীয়, ও সিরিয়ান ভাষায় লিখিত পুস্তকাদি অনুবাদ করার জন্য
830 খৃস্টাব্দে বাগদাদে ”বায়তুল হিকমা” বা জ্ঞানগৃহ নামে একটি অদ্বিতীয় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা
করেন। এই জগৎ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিতে তিনটি ভাগ ছিল। যথা- (ক) গ্রন্থাগার (খ) শিক্ষায়তন
(গ) অনুবাদ ব্যুরো।
●জ্ঞান বিজ্ঞান বিকাশ বায়তুল হিকমার অবদান:
আব্বাসীয় জ্ঞান বিজ্ঞান বিকাশে খলীফা আল মামুনের অবদান
ছিল অপরিসীম। তিনি 830 খৃস্টাব্দে বায়তুল হিকমা নামক জ্ঞানাগার নির্মাণ করেন। আব্বাসীয়
আমলে জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশে বায়দুল হিকমার ভূমিকা নিম্নে আলোচনা
করা হল:
1) শিক্ষার
সম্প্রসারন: আব্বাসীয় খলিফা মামুনের দৃস্টিতে শিক্ষা ছিল এমন একটি ভিত্তি যার উপর
মানবাত্নার শান্তি নিহিত। তাই তিনি রাজ্য জয় অপেক্ষা সৃজনশীল সাংস্কৃতিক বিজয়কে অধিক
গুরুত্ব দিয়েছেন। সাংস্কৃতিক চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তিনি বায়তুল হিকমাকে
কেদ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা
ও মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রচুর লাখারাজ সম্পত্তি
নিয়োজিত করেন।
2) কাগজ
উৎপাদন: শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারের জন্য এবং বায়তুল হিকমার অনুবাদ কার্যাবলীকে
নির্বিগ্ন করার জন্য মামুন চীনাদের অনুকরনে কাগজের কল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় প্রচুর
কাগজ উৎপাদনের ফলেই শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। উল্লেখ্য যে, হিজরীর তৃতীয়
শতকে কিছু চীনা কাগজ ইরাকে আমদানী হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই এটি দেশীয় শিল্পে
পরিণত হয়। খলিফা হারুন অর রশীদ সর্ব প্রথম আরবদেশে কাগজের কল প্রতিষ্ঠা করেন।
3) পান্ডুলিপি
সংগ্রহ: ঐতিহাসিক আমীর আলী মামুনের রাজত্বকালকে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উজ্জল
ও গৌরবময় যুগ বলে যে মন্তব্য করেছেন তার মূল কারন হল বায়তুল হিকমার অবদান। বায়তুল হিকমায়
গবেষনারত পারসিক, হিন্দু, গ্রীক, খৃস্টান, আরবীয় প্রভৃতি সম্প্রদাযের মনীষীদের মাধ্যমে
আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ও বৈদেশিক রাজ্য হতে নানা দেশের জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চিত পুস্তকের
পান্ডলিপি আহরণ করেন।
4) অনুবাদ
কার্যাবলী: মামুনের দরবারের উজ্জল রত্ন লব্ধ প্রতিষ্ঠা অনুবাদক হুসাইন ইবনে ইসহাক ছিলেন
বায়তুল হিকমার মহাপরিচালক। তাঁর নেতৃত্বে এখানে অনুবাদ কার্যাবলী চলত বিরামহীনভাবে।
তিনি নিজে গ্রীক ভাষার শিক্ষা লাভ করে গ্রীক অঞ্চল হতে পান্ডুলিপি উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত
হন এবং এসব আরবিতে অনুবাদ করেন। এছাড়া বায়তুল হিকমার অন্যান্য অনুবাদকগন Galen,
Pual, Euclid, Ptolemy প্রমূখ মনীষীরা বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলি এবং বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক
এরিস্টটল এবং প্লেটোর মূল্যবান গ্রন্থাদি আরব ভাষায় অনুবাদ করেন। এ সময় লিউকের পুত্র
কোস্টার এর মাধ্যমে গ্রীক সিরিয়া ও ক্যালডিয় ভাষার গ্রন্থাদি, মানকাহ এবং দাবান নামক
ব্রাহ্মন মনীষীদের দ্বারা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থাদি
আরবিতে অনুবাদ করা হয়।
5) জ্যোতির্বিদ্যার
বিকাশ: খালিদ বিন আব্দুল মালিক, ইয়াহইয়া বিন আল মানসূর, সিন্দু বিন আলী প্রমূখ গনিতজ্ঞ
ও জ্যোতির্বিদগন বায়তুল হিকমার উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন। তারা মানুষের স্থাপিত মানমন্দিরে
গবেষণা করে তৎকালে পৃথিবীর আকৃতি, গ্রহ, বিষুব রেখা, ধূমকেতু, উল্কাপিন্ড প্রভৃতি বিষয়ে
বহু মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেন।
6) চিকিৎসা
শাস্ত্রের উৎকর্ষ সাধন: বায়তুল হিকমা চিকিৎসার জগতে আলোড়ন সৃস্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
এখানকার গবেষক উহান্না বিন মুসাওয়াহ নামক চিকিৎসা বিজ্ঞানী রসায়ন শাস্ত্রের উপর জারির
ভস্মীকরন ও লঘুকরন সূত্র দু‘টি আবিষ্কার করেন। জিব্রাইল ইবনে বখতিয়ার এসময়ের একজন চিকিৎসা
বিজ্ঞানী ছিলেন।
7) গনিত
শাস্ত্রের বিকাশ: যুগ শ্রেষ্ঠ গনিতজ্ঞ ও ভূগলবিদ মুহাম্মাদ বিন মূসা আল খাওয়ারিজমী
(780-850 খৃ) বায়তুল হিকমার একজন মৌলিক গনিত গবেষক ছিলেন। গনিত শাস্ত্রের উপর ”কিতাবুল
জাবর ওয়াল মুকাবালাহ” গ্রন্থটি তার অনবদ্য সৃস্টি। এ গ্রন্থটি ষোড়শ শতাব্দির পূ্র্ব
পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে টেক্সট বুক হিসেবে পড়নো হতো।
8) ধর্মতত্বের
বিকাশ সাধন: বায়তুল হিকমায় ধর্মতত্ব, হাদিস শাস্ত্র এবং ভাষাতত্ব প্রভৃতির ব্যাপক চর্চা
হতো। ধর্মতত্ব বিষয়ে মামুনের পান্ডিত্ব ছিল। হাদিস সংগ্রহকারি হিসেবে ইমাম বুখারীর
নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি 16 বছর ধরে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমন করে ষাট লক্ষ হাদিস
সংগ্রহ করেন। এবং সেগুলোর মধ্য থেকে কেবল 7275 টি হাদিসকে নির্ভুল হিসেবে গ্রহন করা
হয়। এখানে ধর্ম দর্শনের উপর আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়।
9) ফার্সি
সাহিত্যের পুনর্জাগরনে অবদান: বায়তুল হিকমার বদৌলতে মৃতপ্রায় সাহিত্য পুনর্জীবন লাভ
করে। আধুনিক ফার্সি কবিতার স্রষ্টা মার্ভবাসী কবি আব্বাস বায়তুল হিকমার খ্যাতিমান কবি
ছিলেন। ধর্মভীরু ও নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যিক আবুল আতাহিয়া (748-828 খৃ) ধর্মীয় ভাবধারা
সমৃদ্ধ কবিতা রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
10)
সুকুমার শিল্পের বিকাশ:
রুচি সম্মত হস্ত লিখন বা সুকুমার শিল্পের বিকাশে বায়তুল হিকমার অবদান অনস্বীকার্য।
হাম্বলীর বাণীগুলো সুন্দর এবং পরিষ্কার লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আরবগন হস্ত লিখন পদ্ধতির
আবিস্কার করেছিল। আর রায়হানী বায়তুল হিকমার প্রখ্যাত লিপিকার ছিলেন। তার নামানুসারে
একটি লিপির নামকরণ করা হয় রায়হানী।
11) মৌলিক গবেষণায় অবদান:
বায়তুল হিকমার গবেষকগন উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবিস্বরনীয়
অবদান রেখে যেতে সক্ষম হয়ছেন। গ্রীক, পারস্য ও ভারতীয় ভাবধারায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে ধর্মীয়
অনুভূতির পরিবর্তে বিচার বুদ্ধি, যুক্তি তর্ক, প্রগাঢ় অনুশীলনী দ্বারা মুসলমানগন জ্ঞানের
বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখতে সক্ষম হন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের এই সাফল্য
বিজ্ঞান বা সাহিত্যের কোন বিশেষ শাখায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি বুদ্ধিবৃত্তির যাবতীয় শাখায়
প্রসার লাভ করেছিল।
12) ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ:
বায়তুল হিকমা জ্ঞান বিজ্ঞানে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল এর ফলে ইসলামী সভ্যতার
স্বর্ণযুগ সূচনা হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুইর বলেন, এই সমস্ত মনীষীদের পরিশ্রমের ফলে মধ্য
যুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয জাতিগুলোর সাথে তাদের অথচ বিস্তৃত পৈত্রিক সম্পদ গ্রীসের
বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে পুনর্মিলন ঘটে। অনক ঐতিহাসিক একে The golden age of
Islamic civilization বলে অভিহিত করেছেন। আবার অনেকে একে Augustan age বলেও আখ্যায়িত
করেছেন।
●উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে, বায়তুল হিকমার অবদানের ফলে সভ্যতার
যে উন্মেষ ঘটে তা শুধু ইসলামের ইতিহসেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও
অভূতপূর্ব জাগরন সৃ্স্টি করে। প্রকৃত পক্ষে এটি অগাস্টান যুগের অপেক্ষায়ও উজ্জল এবং
গৌরবময় যুগের সূচনা করেছিল। বায়তুল হিকমা পরবর্তিকালে ইউরোপে নবজাগরন সৃস্টিতে বিশেষ
অবদান রাখে।
লেখাটা বেশ ভালো লেগেছে ❤️
উত্তরমুছুনএরকম তথ্যপূর্ণ লেখা লেখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন